লকডাউন শেষে গত পয়লা জুন থেকে শুরু হয়েছে সব ধরনের বাস ও বিমান চলাচল। এর আগের দিন শুরু হয় ট্রেন ও লঞ্চ চলাচল। শর্ত ছিল, করোনাভাইরাস সতর্কতা হিসেবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে গণপরিবহন চলবে। এ জন্য যাত্রী নিতে হবে আসন সংখ্যার অর্ধেক। অর্থাৎ একটি করে আসন ফাঁকা রেখে যাত্রীদের বসাতে হবে, যাতে সামাজিক দূরত্ব বজায় থাকে। এই শর্তের সুযোগ নিয়ে পরিবহন মালিকরা ভাড়া শতভাগ বাড়ানোর দাবি তোলেন। বিআরটিএ এককথায় ৮০ শতাংশ ভাড়া বাড়ানোর প্রস্তাব করে, যা পৃথিবীর ইতিহাসে সম্ভবত একমাত্র রেকর্ড। সড়ক ও সেতুমন্ত্রী সেই প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে কিছুটা কমিয়ে ৬০ শতাংশ ভাড়া বাড়িয়ে দেন। এটিও নিঃসন্দেহে বিশ্বরেকর্ড।
এর পরও কথা ছিল যে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে অর্থাৎ যখন বাসে পুরো আসনে ভরে যাত্রী পরিবহনের সুযোগ সৃষ্টি হবে তখন ভাড়া ফের কমানো হবে। এসব শর্ত মেনেই পরিবহন মালিকরা সড়কে যানবাহন নামিয়েছেন। কিন্তু প্রথম দু’দিন না যেতেই তারা শর্ত লঙ্ঘন করেছেন। সব জাতীয় দৈনিক ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় খবর আসছে বাসে এক সিট ফাঁকা রাখার শর্ত মানা হচ্ছে না। বাস ভরে যাত্রী তোলা হচ্ছে। কিছু যাত্রী প্রতিবাদ করলেও তোয়াক্কা করছে না চালক ও হেলপাররা। ভাড়া কিন্তু অতিরিক্ত হারেই আদায় করা হচ্ছে। রাজধানী ঢাকা এবং এর আশপাশের সব জায়গাতে একই চিত্র। বেশি যাত্রী পাওয়ায় বাসগুলো স্বাস্থ্যবিধিকে বুড়ো আঙুল দেখাচ্ছে। মনের আনন্দে বেশি অর্থ পকেটস্থ করছে। অনেক বাস এমনকি দাঁড়িয়েও যাত্রী নিচ্ছে।
৬০ শতাংশ ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছেন যে সড়ক পরিবহনমন্ত্রী তিনি বলেছেন, গণপরিবহনে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় এবং অর্ধেক আসনের বেশি যাত্রী তোলার যে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে তা সংশ্লিষ্টদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের শামিল। গত শুক্রবার নিজ বাসভবন থেকে অনলাইনে এক কর্মশালার উদ্বোধনকালে মন্ত্রী ওই মন্তব্য করেন। সংশ্লিষ্টরা শর্ত ‘ভঙ্গ করছেন’ বা করেছেন এমনটাও বলেননি মন্ত্রী। শর্ত ভঙ্গের কথা বললে তো ব্যবস্থা নেয়ার কথা উঠবে। বিশ্বের অন্য কোনো দেশে বর্তমান পরিস্থিতিতে পরিবহন ভাড়া বাড়ানোর দৃষ্টান্ত নেই। করোনায় বিপন্ন মানুষের ওপর ৬০ শতাংশ বাড়তি ভাড়ার বোঝা চাপিয়ে দেয়ার মতো চরম গণবিরোধী সিদ্ধান্ত যে মন্ত্রী নিতে পারেন তার পক্ষে শর্ত ভঙ্গের কারণে পরিবহন মালিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া কি আদৌ সম্ভব? এমন একটি নজিরবিহীন সিদ্ধান্ত নেয়ার পেছনে অন্য কোনো স্বার্থের বিষয় নেই তা-ইবা কে হলফ করে বলতে পারে?
পরিবহন মালিকরা যাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য বিআরটিএ’র বিধিমালাও মানছেন না। কোনো রকম ফিটনেস ছাড়াই গাড়ি নামিয়েছেন সড়কে। পত্রিকায় খবর এসেছে, দেশের প্রায় ৮০ শতাংশ বাস ও মিনিবাস নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করেন না মালিকরা। কোনোটির ব্রেক ঠিক নেই, ইঞ্জিন ও ব্যাটারির কার্যকারিতা নেই বললেই চলে। কোনোটিরবা চাকা নষ্ট।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক একটি পত্রিকাকে বলেন, ‘চালকরা মালিকদের মুনাফা উঠাতে ভাঙাচোরা গাড়িই চালাচ্ছেন।’ বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের এক নেতা একটি দৈনিককে বলেছেন, তিনিও ৮০ শতাংশ বাস রাস্তায় নামাতে পারেননি। ফিটনেস নেই বলে। তার পরও পরিবহন শ্রমিকরা পেটের দায়ে রাস্তায় গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছেন। তার অর্থ হলো সড়কে চরম বিশৃঙ্খলা চলছে। সড়ক দুর্ঘটনা গত এপ্রিলের তুলনায় বেড়েছে ৭৯ শতাংশ। এ এক অবিশ্বাস্য ঘটনা। রোড সেফটি ফাউন্ডেশন গত মে মাসে দেশে ২১৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২৯২ জন নিহত হয়েছে বলে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাদের তথ্য মতে, গত এপ্রিলে ১১৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ১৩৮ জন নিহত হন।
বর্তমান সেতুমন্ত্রীর সময়েই নিরাপদ সড়ক চাই নামে দেশে এক অভূতপূর্ব আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল। কিন্তু সরকার সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তো পারেইনি বরং বিশৃঙ্খলা আরো বাড়িয়েছে। এখন এক লাফে ৬০ শতাংশ ভাড়া বাড়ানোর যে কাজটি তারা করেছে তাতে সরকারের জনবান্ধব ভাবমূর্তির উল্টো পিঠে ভিন্ন চিত্রই বেরিয়ে পড়েছে। আমরা বলতে চাই, যেহেতু আসন ফাঁকা রেখে গণপরিবহন চলছে না, তাই অযৌক্তিক বাড়তি ভাড়া এক্ষণ, এই মুহূর্তে বাতিল করা হোক।
Leave a Reply